সাইকেলে সিকিম ভ্রমণ – ২য় পর্ব

আছি তিস্তা বাজার, গন্তব্য গ্যাংটক। মেঘাচ্ছন্ন সকাল, সাইকেলখানা নিয়ে বের হলাম। চারিদিক ঘোলা, রাস্তার সব গাড়িতে হেডলাইট জ্বালানো। আমিও আমার সাইকেলের হেডলাইট ও ব্যাকলাইট জ্বালিয়ে নিলাম। পাহাড়ের ঢালে উঁচু নিচু রাস্তা, পাশেই বয়ে চলা তিস্তা নদী, নদীর পাশ ধরে আকাবাকা রাস্তা। কি নিদারুন সৌন্দর্য আহা। রাস্তার ধারে কিছুদূর পর পর বড় বড় খাচায় পাহাড়ী কমলার পসরা সাজিয়ে বসে আছে স্থানীয় বাসিন্দারা। এমন দারুন কমলা দেখে লোভ সামলাতে না পারা আমি অনেকগুলো কমলা কিনে নিলাম। খেতে যেমন মিষ্টি তেমন সুস্বাদু । তিস্তা বাজার থেকে ২৪ কি.মি. যেতেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও সিকিম রাজ্যের সীমান্তবর্তী ব্রীজ। জায়গাটার নাম রংপো চেকপোস্ট। এই চেকপোস্ট থেকেই সিকিমে ভ্রমণের অনুমতি নিতে হবে। ব্রীজে যেতেই পুলিশ থামতে বললেন, জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে এসেছো ? বললাম বাংলাদেশ , তারপর পাসপোর্ট চেক করলেন এবং ফরেন টুরিস্ট অফিসটি দেখিয়ে দিলেন। অফিসে গিয়ে দেখি অনেক বড় লাইন। আগের বিকালে যেসব বাংলাদেশিরা শিলিগুড়িতে থেকে আজকে সকালে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা করেছেন তারা। সাইকেলটাকে সিঁড়ির কাছে রেখেই আমি দোতলায় অফিসের ভেতরে চলে গেলাম। এদিকে লাইনে দাড়িয়ে থাকা টুরিস্টরা আমাকে বলছে : আপনি লাইন না ধরে ভেতরে যাচ্ছেন কেন ? আমি বললাম অফিসার সাহেবের সাথে কথা বলব, এই বলে অফিসের ভেতরে চলে গেলাম। সাইক্লিং পরিহিত পোশাকে আমি, মাথায় আবার হেলমেট, চোখে স্পোর্টস গ্লাস – কোমল সুরে বললাম স্যার একটু কথা ছিলো। উনি আমাকে দেখে একটু নড়ে বসলেন এবং বললেন কে তুমি ? আমি আমার পাসপোর্ট বের করে উনাকে দিলাম এবং সিকিমে সাইকেল ভ্রমণের পুরো প্ল্যানটা বললাম। উনিতো আমার কথা শুনে বেশ অবাক, তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কতজন ? বললাম আমি একা। এই কথা শুনে উনি দাড়িয়ে গেলেন বললেন তুমি একা ?? বাংলাদেশ থেকে একা চলে এসেছো ?? সাইকেল কোথায় তোমার ?? তারপর নিচে এসে সাইকেল দেখলেন। তারপর তিনি নিজেই ফরম পূরণ করলেন এবং ১০ দিনের অনুমতি দিয়ে দিলেন। এদিকে লাইনে দাড়ানো লোকজন আমাকে দেখে হা করে আছে, বলছে ভাই আপনি কে ? আমরা ঘন্টার পার ঘন্টা দাড়িয়ে আছি , আর আপনি হুট করে এসে কাজ সেরে গেলেন। আমি বললাম সাইকেল ট্রাভেলার, এই বলে মুচকি হেসে বেড়িয়ে পরলাম। তারপর রংপো বাজারের ভেতরে একটা রেষ্টুরেন্টে বসলাম নাস্তা করার জন্য। নাস্তা হিসেবে ছিল ছোট ছোট চাপাতি রুটি , ডিম ভাজি, চানাডাল ও কফি। নাস্তা করে সাইকেলে যাত্রা শুরু করলাম।

Foreigners Reporting Office, Rangpo, East Sikkim, INDIA

তিস্তা নদীর ধার ধরে আকাবাকা পাহাড়ী রাস্তা, তিস্তা নদীর সবুজ পানি ও রাস্তার ধারের স্থানীয় সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম সিংতাম বাজারে। পাহাড়ী ঢালে উঁচু নিচু ধাপে ধাপে সাজানো ঘরবাড়ি নিয়ে সুন্দর একটি ‍উপশহর । রাস্তার পাশেই একটা রেষ্টুরেন্ট দেখতে পেলাম, পাহাড়ী রাস্তায় অনেকদূর সাইকেল চালালাম এবার একটু ভুড়িভোজ হয়ে যাক । চিকেন রোল ও ভেজ চাওমিন নিয়ে খেতে বসলাম। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। গ্যাংটক আরো ২৮ কি.মি. কিন্তু এই ২৮ কি.মি. রাস্তা পুরোটাই আপহিল । পাহাড়ে সাইকেল চালাতে গেলে অনেক হিসাব করে চালাতে হয়। খুব বেশি প্রেশার দেয়া যাবে, ধীরে ধীরে গিয়ার লো করে চালাতে হবে। অনেকেই পাহাড়ী রাস্তায় সাইকেল নিয়ে অসুস্থ্য হয়ে পরে, কারণ সঠিক গাইডলাইন। পাহাড়ে সাইকেল চালাতে গেলে গিয়ার এর হিসাবটা খুব বেশি প্রয়োজন। কতটুকু খাড়া রাস্তায় কেমন গিয়ার বা ঢালুতে নামার সময় কেমন গিয়ার এরূপ। উচু রাস্তায় গিয়ােরের পাশাপাশি প্যাডেল প্রেশারটাও খুব হিসেবের, নইলে কিছুদূর যেতেই ক্লান্ত বা অসুস্থ্য হয়ে পরতে হবে। আমি সেসব নিয়মাবলী মেনেই ধীরে ধীরে চালাচ্ছি।

Tista – Gangtok Road

সিংতাম থেকে তিস্তা নদী ভাগ হয়ে গেছে । গ্যাংটকের দিক যেই নদীটি গেছে তার নাম রানীখোলা। রানীখোলা নদীর পাড় ধরেই গ্যাংটকের রাস্তা। সিংতাম থেকে ১০ কি.মি. সাইকেল চালালাম এবং কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতির জন্য একটা চায়ের দোকানে থামলাম। বসে চা খাচ্ছি, পাশে দাড়িয়ে ছিল একটা পুলিশের গাড়ি। গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলেন একজন অফিসার এবং আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আমার পাসপোর্ট দেখালাম এবং আমার ট্যুর প্ল্যন বললাম যে : আমি ২/৩ দিন গ্যাংটকে সাইকেলে ঘুরতে এসেছি। উনি অবাক হয়ে বললেন একা ?? বেশ ভালো বেশ ভালো । তারপর উনি গাড়ী থেকে একটা ব্যাগ দিলেন, যাতে ৭-৮ টা বড় বড় কমলা ছিল এবং সাথে আমার চা নাস্তার বিলটাও দিয়ে দিলেন। সাইকেল নিয়ে ঘুরলে যে কত দিক থেকে সুবিধা পাওয়া যায় , তা বলে বুঝাতে পারবো না। যাক, উনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। দুপাশের নিদারুন সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ভুলেই গেলাম যে উচুতে সাইকেল চালাচ্ছি। ছোট বড় উচু ‍নিচু পাহাড়ের পাদদেশের মানুষের বসতবাড়ি, পাশে বয়ে চলা রানীখোলা নদীর অপূর্বতা মনকে প্রাণবন্ত করে দিল।

এদিকে সন্ধা ঘনিয়ে আসছে, একটা জায়গায় থেমে সাইকেলের লাইট জ্বালিয়ে নিলাম। পাহাড়ী অঞ্চলে বিকালের দিকেই চারদিক অন্ধকার হতে শুরু করে, ঠান্ডাও পরে বেশ। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে পৌছালাম সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের এম জি মার্গ এ । সারাদিন পাহাড়ী রাস্তা সাইকেল চালিয়ে অবশেষে গন্তব্যে পৌছালাম। এবার হোটেল খোজার পর্ব। অনেকগুলো হোটেলে গেলাম, কিন্তু তাদের কাছে ফরেন টুরিস্ট পারমিট নেই তাই আমি থাকতে পারবোনা। একটা হোটেল পেলাম এখানের মালিক কোলকাতার বাঙ্গালী একজন ভদ্রমহিলা। উনার হোটেলেও ফরেন টুরিস্ট পারমিট নেই।

MG Marg, Gangtok, Sikkim

ফরেনদের জন্য অন্য পাশে অনেক হোটেল রয়েছে, কিন্তু আমি রাস্তার কাছেই থাকতে চাইলাম সাইকেলের সুবিধার দিক চিন্তা করে। । হোটেলের ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন আমাদের হোটেলে তুমি থাকতে পারবে তবে তুমি নিজে থানায় গিয়ে যদি অবগত করতে পারো তবে । যেই কথা সেই কাজ, আমি হুট করে চলে গেলাম থানায়। হোটেলের কাছেই ছিল থানাটি , থানায় গিয়ে ইনফরমেশন ডেস্কে গিয়ে বললাম সবকিছু, উনি একজন অফিসারে কাছে যেতে বললেন, আমি উনার কাছে গিয়ে আমার কথা বললাম। অফিসার একটু রেগে গিয়ে আমাকে বললেন কোন হোটেল ?? নম্বর দাও , আমি হোটেলের কার্ড বের করে দিলাম। অফিসার কল করলেন এবং হোটেলের সেই ভদ্র মহিলাকে একটু জোর গলায় বললেন একটা ছেলে সাইকেল নিয়ে আমাদের শহরে ঘুরতে এসেছে , এই ঠান্ডা রাতে বাইরে ঘুরছে , আপনি তাকে থাকতে দেননি কেন ? ভদ্রমহিলা বললেন স্যার আমার হোটেলের ফরেন পারমিট নেই। অফিসার বললেন আমি ওর পাসপোর্ট ও ভিসার ফটোকপি রেখে দিচ্ছি, আপনিও এক কপি রেখে দেবেন আর ওর যতদিন সিকিম পারমিট আছে ততদিন থাকবে কোন অসুবিধা যেন না হয়, ও আমাদের মেহমান। আমি অফিসারে কথা শুনে অবাগ হয়ে গেলাম , তারপার উনার সাথে হাত মিলিয়ে চলে এলাম হোটেলে। হোটেলে যেই রুমটা পেলাম সেটা ৪ জন থাকার রুম, কিন্তু ভাড়া আমার জন্য মাত্র ৬০০ টাকা। খুবই চমৎকার রুম, ভেতরে কাঠের সুন্দর ডিজাইন করা, যাক ভালোই হলো। এদিকে বাইরে প্রচুর ঠান্ডা ১-২ ডিগ্রি , রাতেই মাইনাস এ চলে যাবে। তাই তারাতারি করে চলে এলাম এম জি মার্গ এ রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। এম জি মার্ক গ্যাংটকের প্রাণকেন্দ্র। চমৎকার ভাবে সাজানো জায়গাটিতে সবসময়ই জমজমাট থাকে। ওখানে একটা বাঙ্গালী হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবারে ছিলো ভাত, মুরগীর মাংশ, সবজি, পাপর ভাজা, ডাল । দামটা তুলনামূলক ভাবে একটু বেশিই ছিল। এম জি মার্গ এ কিছুক্ষণ ঘুরে চলে এলাম হোটেলে। পরদিন খুব সকালে বের হতে হবে গ্যাংটকের আসেপাশে ঘুরবার জন্য।

বি:দ্র:

পরিবর্তনটা শুরু হোক আমাদের নিজেদের থেকে, আমাদের ঘর থেকে। আমাদের ঘরকে আমরা ঠিক যেভাবে গুছিয়ে রাখি – আমরা চাইলে আমাদের পাড়া, মহল্লা, দেশ তথা পুরো পৃথিবীকে গুছিয়ে রাখতে পারি। শুধু প্রয়োজন সচেতনতা। ময়লা আবর্জনা যেভানে সেখানে না ফেলে, নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবো। অপচনশীল যেকোন আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ/প্যাকেট, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক , প্লাস্টিক বোতল এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবো অথবা নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করবো। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদের। ভ্রমনে গিয়ে পরিবেশের যেন কোন ক্ষতি না হয় সেই দিক খেয়াল রাখা আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। নিজেরা নিজেদের জায়গা থেকে পরিবেশ রক্ষার কাজ করলে, প্রথিবী আরো সুন্দর ও সবুজে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

Share Your Social Media

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top