ভোর 5 টা, মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠলো। আমরা আছি কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনাতে, আজকের গন্তব্য সুনামগঞ্জ। ইটনা জায়গাটা একটা দ্বীপের মতন। ইটনা থেকে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ ঘাটে আমাদের ট্রলারে যেতে হবে, তারপর রাস্তা শুরু। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কল করলাম মাঝিকে, রাতেই সব ঠিক করে দেন মেহেদী ভাই। কিছুক্ষণ পর ট্রলার চলে এলো আমাদের ক্যাম্প গ্রাউন্ড রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সরকারী কলেজ ঘাটে। আমি, গাফ্ফার, পারভেজ, রাজেশ দা, জাহাঙ্গীর ও সামী সহ আমরা মোট ৬ জন। সামী আমাদের সাথে ১ দিন থাকার জন্য এসেছিল, তাই সে ইটনা থেকেই বেক করবে চামড়াবন্দর হয়ে কিশোরগঞ্জ। আমরা ছবি তুললাম আর তাকে বিদায় জানিয়ে আমাদের সাইকেলগুলো ট্রলারে উঠালাম। আমাদের ট্রলারটি ছোট তাই সাইকেলগুলো ভালোভাবে বেঁধে নিলেন মাঝি। এদিকে আবহাওয়া খুবই খারাপ, ঝড় আসছে আসছে ভাব। উপরওলার নাম স্মরণ করে আমাদের ট্রলারটি স্টার্ট করলো। কিছুদূর যেতেই আবহাওয়া চরমভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রচন্ড বাতাস সাথে বৃষ্টি। আমাদের ৫ জনের মধ্যে, রাজেশ দা ও পারভেজ মোটেও সাতার জানেনা। ভয় আরো বেড়ে গেল। ট্রলারটি প্রচন্ড বেগে দুলছিলো এদিকে আবার বৃষ্টি। ট্রলার থেকে পানি অপসরন করতে হচ্ছে দ্রুত। আবহাওয়ার এ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ চললে ট্রলারকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না, সাতার যত ভালোই জানিনা কেন কুলহারা এই হাওড়ের বুকে বেশিক্ষণ টিকে থাকা যাবে না। অনেক সময় ধরে ঝড়ের সাথে লড়াই করে হাল ছেড়ে দিয়ে মাঝি বলল আর সামনে আগানো যাবে না, বলেই ট্রলার ঘুরিয়ে দিলেন। কিছুদূরে একটা পাড় দেখা যাচ্ছে, সেখানে ট্রলারটি ভিড়ালেন।

ছোট্ট একটা বাজার। ঝড় বৃষ্টি এখনও চলছে, এই ফাকে আমরা সকালের নাস্তা সেড়ে নিলাম। ঘন্টা খানেক পর আবহাওয়া মোটামুটি ভালোর দিকে। আমাদের ট্রলারটি আবার যাত্রা শুরু করল। তীরহারা হাওড়ের বুকে থই থই পানি, মাঝে মাঝে ছোট ছোট দুই একটা বসতি আর মাঝ ধরার ট্রলার । অনেক ঘরবাড়ি ডুবে গেছে, আবার অনেক ঘরবাড়ি পানির সাথে যুদ্ধ করে কোনরকন টিকে আছে। হাওড় অঞ্চলের জীবন জিবিকা সত্যিই খুব কষ্টকর। মানুষ কিভাবে করে বেচেঁ আছে তা খালি চোঁখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না । মাসে বা সপ্তাহে একবার যান হাট-বাজারে, নেই তেমন পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা, নেই তেমন শিক্ষা ব্যবস্থা। স্কুলে যেতে বাচ্চাদের ১-২ ঘন্টা নৌকায় চড়তে হয়। আমরা হাওড়ে চলছি, এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি অনুধাবন করছি আর ভাবছি উপরওয়ালা আমাদের কতটা আরাম আয়েশে রেখেছে, আর কত মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে দিন রাত লড়াই করে যাচ্ছে।প্রায় দেড় ঘন্টা ট্রলার যাত্রার পর আমরা পৌছালাম আমিরগঞ্জ নাম ছোট্ট একটি বাজারঘাটে। বাজারটি পানিতে প্রায় ছুই ছুই অবস্থা। মাঝি বললেন বাজারটা পেড়িয়ে আরেকটা নৌকায় চড়ে নদী পাড় হলেই আজমিরিগঞ্জ, আজ যদি আমার ট্রলারে সরাসরি আজমিরিগঞ্জ ঘাটে নামতে চান তাহলে আরো ১ ঘন্টা ট্রলারে কয়েকটা গ্রাম ঘুরে সেই ঘাটে পৌছাতে হবে। আমরা চিন্তা করলাম এত সময় নষ্টা না করে বরং উনার কথা মতই যাই। ট্রলার যে পাড়ে ভিড়িয়েছে হাটু সমান পানি , কি আর করার সাইকেল নিয়ে বাজারে ভেতর দিয়ে পরের ঘাটে পৌছে গেলাম। নদীর পাড়ে একটা দোকান থেকে হালকা চা নাস্তা করে নৌকায় উঠে পরলাম। ১০ মিনিট সময় লাগলো আমরা পৌছালাম হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ ঘাটে। সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। পারভেজ একটু আগে চালাচ্ছিল । আমরা যাচ্ছি বানিয়াচং রুটে। বানিয়াচং হল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্রাম। কিছুদূর যেতেই খেয়াল করলাম পারভেজ আমাদের রুটে নেই, নিশ্চই অন্য রুটে চলে গেছে। কল করলাম, হুম ঠিক সে অন্য রুটে প্রায় ৫ কি.মি. চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে সে আসলো, আমরা একসাথে সাইকেল চালাচ্ছি। কিছুদূর যেতেই দেখলাম গ্রাম্য গাছগাছালী ছেড়ে হাওরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। নেই কোন গাছ, চারিদিকে থই থই করা পানি আর পানি। সূর্য একদম মাথার উপর। রৌদ্রের প্রখরতা অসহনীয়। ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম। পথের ধারে হঠাৎ একটা খালি নৌ দেখতে পেলাম, গাফ্ফার বলছে ; চল একটু ডুবাডুবি করে ঠান্ডা হয়ে নেই । যেই কথা সেই কাজ, নেমে পরলাম পানিতে। এই গরমে, ঠান্ডা পানিতে সাতার কাটতে কার না ভালো লাগে। ডুবাডুবি শেষ করে পুনরায় সাইকেল চালাতে লাগলাম। ৩/৪ কি.মি. গিয়ে শিবপাশা নামক বাজারে রাস্তার ধারে টিউবওয়েল দেখে দাড়ালাম। ফ্রেশ হলাম ও তৃপ্তি সহকারে পানি পান করে নিলাম। এমন একজন ব্যক্তি আমাদের ডেকে বললেন ভাই ডা: সাহেব আপনাদের দেখা করতে বললেন। আমার গেলাম, উনি একজন গ্রাম্য ডা: এবং এই বাজারের সভাপতি। আমাদের সাথে কথা বললেন এবং আমাদের জন্য কিছু চা নাস্তার আপ্যায়ন করলেন। এর মধ্যে পুরো বাজারে ভীর জমে গেছে। কারণ : আমাদের ভিন্নরকম সাইকেলেগুলো ঐ এলাকায় নতুন, আর আমাদের মতন কোন ট্রাভেলার সেসব এলাকায় কখনও যায় না, তাই তারা আমাদের দেখতে ও ছবি তুলতে ভীর পরে গেছে।

সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বানিয়াচং এর দিকে যাচ্ছি।৫/৬ কি.মি. চালিয়ে পৌছালাম বানিয়াচং। একটা ফাস্টফুডের দোকান থেকে ভেজরোল নিয়ে নিলাম, হালকা নাস্তার জন্য। কারণ আমাদের টার্গেট নবীগঞ্জে গিয়ে দুপুরের খাবার খাবো। বাজার ক্রস করে কিছুদূর যেতেই রাস্তার ধারে একটা লেবুর শরবতের দোকান দেখে দাড়িয়ে পরলাম। একেকজন ৪/৫ গ্লাস করে ঠান্ডা লেবুর শরবত মেরে দিলাম। সামনের দিকে এগোচ্ছি, হাওড় যেন পিছু ছাড়বেনা। ১০ কি.মি. আরেকটা হাওড়ের রুটে যাচ্ছি। রৌদ্রের প্রখরতা এতটাই যে ২/১ কি.মি. যেতেই থামতে হচ্ছে। রাস্তার দুইধারে কিচ্ছু নেই, প্রচন্ড গরমে সবার অবস্থা নাজেহাল। একজায়গায় ছোট্ট কয়েকটা গাছ পেলাম। হ্যামক ঝুলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। দুপুর ২ টা, সারাদিনে সাইকেল চালিয়েছি মাত্র ১৮ কি. মি.। এদিকে পারভেজের প্রকৃতির ডাক দিয়েছে, কিন্তু দুর্গম এলাকায় কোথায় পাবে টয়লেট ! দিক বেদিক কোন কিছু না দেখে বসে পরলো একটা ঝোপে। সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু এমন হলে আমাদের গন্তব্যে পৌছানো কঠিন হয়ে যাবে। বিকাল ৪ টায় সব গুছিয়ে আবার রওনা করলাম। সামনে কাগাপাশা নামক একটা বাজার পেলাম, সেখানে খাবার খুজতে লাগলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য খাবার পেলাম না। নিরাশ হয়ে আবার চলতে লাগলাম। বিকাল ৫ টার দিকে পৌছালাম নবীগঞ্জ বাজারে। কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের কাছে একটা হোটেলে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে। মুরগীর মাংশ, ভাজি ও ডাল দিয়ে ভোজনটা সেরে নিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি যেন কেটে গেল। জাহাঙ্গীর সেখান থেকে সিলেটের বাস ধরে বেক করবে। সে আবার ২ দিন পরে সিলেটে আমাদের সাথে জয়েন করবে। তাকে বিদায় দিয়ে আমরা সুনামগঞ্জের উদ্যেশ্যে রওনা করলাম, দুরত্ব ৮০ কি.মি., এর মধ্যে ৫০ কি.মি. রাস্তা হাওড়ের মধ্য দিয়ে। যেভাবেই হোক দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে হাওড়ের পথ শেষ করতে হবে, বেশি রাত হলে ডাকাতের কবলে পরার সম্ভাবনা আছে। আমরা ৪ জন চলছি, ২৫-২৮ কি.মি. পার ঘন্টা গতিতে। রাজেশ দা একদম নতুন সাইক্লিং করছে, তাই কিছুদূর পর পর বিরতি দিয়ে চালাচ্ছি। নবীগঞ্জ থেকে ৭/৮ কি.মি. যেতেই এক অদ্ভুদ চমৎকার রাস্তা পেলাম। রাস্তার দুইধারে সারি সারি ইউকেলিপটাস গাছের সমারোহ, এমন পরিবেশ দেখে কিছুটা স্বস্থি পেলাম। এখন ঠান্ডা হাওয়া। সমান্তরাল গতিতে সাইকেল চালাচ্ছি। ঠিক সন্ধ্যা, আমরা একটা গ্রাম্য বাজারে পৌছালাম, সেখানে চা নাস্তার ছোট্ট বিরতি। সবার সাইকেলের সামনের ও পেছনের লাইট এবং নাইট ভিশন গ্লাস পরে নিলাম।

বিরতি শেষে আবার চলতে শুরু করলাম। চাঁদনী রাতে হাওড়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি, অসাধারণ অনুভূতি আবার ভয়ও কাজ করছে। জনশূন্য এইখানে হুট করে কোন ডাকাতের কবলে পরলে শেষ। একটা পর্যায়ে গিয়ে রাস্তা শেষ, নৌকা দিয়ে নদী পাড় হয়ে পৌছালাম রানীগঞ্জ বাজার, সেখান থেকে আবার নতুন রাস্তা। স্থানীয় লোকজন বলছিল : আপনারা দ্রুত চলে যান, বেশি রাত হলে সমস্যায় পরবেন। ৯/১০ কি.মি. গিয়ে পৌছালাম জগন্নাথপুর বাজারে। অনেক বড় একটা বাজার। পাশেই একটা মসজিদে গেলাম ফ্রেশ হওয়া ও পানি নেওয়ার জন্য। এদিকে সুনামগঞ্জের দ্বীপ বণিক দাদা কল করে খোঁজ নিচ্ছিলেন, উনি আমাদের জন্য সুনামগঞ্জ শহরে হোটেলের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। রাত ৯ টা, আমরা জগন্নাথপুরে, এখান থেকে সুনামগঞ্জের দুরত্ব ৪৫ কি.মি.। যেই মসজিদে ফ্রেশ হতে গেলাম, আমাদের গল্প শুনে মসজিদের ইমাম সাহেব কিছু মেহমানদারী করতে চাইলেন, কিন্তু যেতে হবে বহুদূর তাই সময় দিতে পারলাম না। আমরা আবার চলতে লাগলাম, সামনে জনশূন্য প্রায় ২০ কি.মি. হাওড় পারি দিতে হবে। আমরা সাধারণ থেকে একটু বেশি গতিতে সাইকেল চালাতে লাগলাম। রাত ১১ টার দিকে পৌছালাম সিলেট-সুনামগঞ্জ হাইওয়ের ডাবর নামক স্থানে। একটা দোকানে বিরতি দিলাম। সুনামগঞ্জ আরো ২২ কি.মি.। দোকানে নাস্তা করতে করতে দোকান্দার অামাদের গল্প শুনলেন। সব শুনে তিনি বললেন, ভাই পাশেই ফাকা জায়গায় একটা মসজিদ আছে, আপনারা চাইলে আজকের রাতটা এখানেই কাটাতে পারেন। ভেবে দেখলাম, চমৎকার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। কারণ সুনামগঞ্জ যেতে আরো দেড় ঘন্টা সময় লাগবে, আর হাইওয়েতে নাইট কোচ গাড়িগুলো এত জোরে চালায়, তাতে আজকে এখানেই থাকাটা শ্রেয়। দ্বীপ বণিক দাদাকে কল করে জানিয়ে দিলাম আমাদের অবস্থান। তারপর সে দোকান থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনে আমরা মসজিদে চলে গেলাম। একদম ফাকা একটা জায়গায় অবস্থিত। চাঁদনী রাতে ফাকা জায়গায় সাদা রঙ্গের মসজিদটি ঝল ঝল করছে। মসজিদে পেলাম টিউবওয়েল, সবাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। চারিদিকে খোলামেলা হওয়ায় নির্মল ঠান্ডা হাওয়া ও চাঁদনী রাতের ঝলকানিতে এক চমৎকার ভালোলাগা অনুভূত হতে লাগলো।শুকনো খাবার খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পরলাম।পরেরদিন গন্তব্য ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর।
বি:দ্র:
পরিবর্তনটা শুরু হোক আমাদের নিজেদের থেকে, আমাদের ঘর থেকে। আমাদের ঘরকে আমরা ঠিক যেভাবে গুছিয়ে রাখি – আমরা চাইলে আমাদের পাড়া, মহল্লা, দেশ তথা পুরো পৃথিবীকে গুছিয়ে রাখতে পারি। শুধু প্রয়োজন সচেতনতা। ময়লা আবর্জনা যেভানে সেখানে না ফেলে, নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবো। অপচনশীল যেকোন আবর্জনা যেমন পলিব্যাগ/প্যাকেট, বিভিন্ন রকম প্লাস্টিক , প্লাস্টিক বোতল এবং ধাতব দ্রব্য ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবো অথবা নিজেদের সাথে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে ধ্বংস করবো। এই পৃথিবীটা আমাদের অতএব, এটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদের। ভ্রমনে গিয়ে পরিবেশের যেন কোন ক্ষতি না হয় সেই দিক খেয়াল রাখা আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। নিজেরা নিজেদের জায়গা থেকে পরিবেশ রক্ষার কাজ করলে, প্রথিবী আরো সুন্দর ও সবুজে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।